newsbhuban25@gmail.com মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫
৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

চরের চাষিদের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে বিনা খরচের ‘কাশবন’

নিউজ ভুবন ডেস্ক প্রকাশিত: ৩০ অক্টোবর ২০২৫ ১১:১০ এএম

'চর মনতলা' ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে জেগে ওঠা ভূখণ্ড

ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে একখণ্ড ভূখণ্ড, যার নাম 'চর মনতলা'। এই চরের চাষিদের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে বিনা খরচের ‘কাশবন’।

একসময় ধুধু বালুচর ছিল এ অঞ্চল, যেখানে তেমন ফসল ফলত না। এখন সেই নির্জন বালুচরেই ফুটেছে কৃষকদের মুখে হাসি। কারণ, এখানে জন্ম নিচ্ছে 'বিনা খরচের ফসল' কাশ।

চরের চাষি নুরুল ইসলাম, খবির উদ্দিন, শামসুল মণ্ডল, আবির আলী ও লোকমান হোসেন—সবারই গল্প এক। কৃষিকাজে নানা অনিশ্চয়তার মধ্যেও তারা প্রতিবছর কাশ বিক্রি করেন। এ থেকে তাদের আয়ও বেশ, যা অন্য কোনো ফসল থেকেও মেলে না।

নুরুল ইসলাম জানান, তার চার একর জমির মধ্যে দুই একর এখন ধু ধু বালুচর। সেখানেই প্রাকৃতিকভাবে জন্মেছে কাশ। 'কাশের জন্য কোনো সার, কীটনাশক বা পরিচর্যা লাগে না,' বলেন তিনি। 'শুধু কাটার সময় শ্রমিকদের খরচ দিতে হয়। প্রতি একরে খরচ হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।'

তিনি জানান, গত বছর দুই বিঘা জমি থেকে প্রায় ৫০ হাজার আঁটি কাশ সংগ্রহ করে আট থেকে ১০ টাকা দরে বিক্রি করেছিলেন। মোট বিক্রি করেছিলেন চার লাখ ৫০ হাজার টাকার কাশ। চোখে আনন্দের ঝিলিক নিয়ে নুরুল বলছিলেন, 'এই ফসল সত্যিই আমাদের আশীর্বাদ।'

লোকমান হোসেন জানান, তার চার বিঘা বালুচর জমিতেও কাশবাগান হয়েছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি কাশ কাটা শুরু হবে। তিনি বলেন, 'বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকার এসে কাশ কিনে নিয়ে যান। পানচাষে কাশের চাহিদা অনেক। দামও ভালো পাই।'

লালমনিরহাটের ধরলা নদীপাড়ের চর ফলিমারীর কৃষক সিরাজুল ইসলাম জানান, গত বছর দুই বিঘা জমির কাশ বিক্রি করে পেয়েছিলেন এক লাখ ৩০ হাজার টাকা, খরচ হয়েছিল ৩৫ হাজার। এবার তার চার বিঘা জমিতে কাশবাগান হয়েছে। 'একজন ব্যবসায়ী আগেই আমাকে ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছেন। কাশ এখন অনেক চরের কৃষকের মুখে হাসি এনে দিয়েছে।'

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার ও ধরলা নদীর চরে তিন শতাধিক কাশবাগান রয়েছে, যেখানে প্রায় ৫৫০টি চরের মধ্যে অধিকাংশই কাশ উৎপাদনের উপযোগী। প্রতিটি বাগান ৫ থেকে ২০ একর পর্যন্ত বিস্তৃত। এসব চরে প্রতিবছর উৎপাদিত হয় প্রায় ৯ থেকে ১০ কোটি আঁটি কাশ। নভেম্বরের মাঝামাঝি কাটা শুরু হয়ে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে বিক্রি। নদীপাড়ের এসব কাশ নৌকা ও ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়।

চিলমারীর জোড়গাছ এলাকার কাশ ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান জানান, প্রতিবছর ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পাড়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকার কাশের ব্যবসা হয়। 'আমরা অনেক চাষিকে অগ্রিম টাকা দিই। দেশের নানা প্রান্তের পাইকাররা আমাদের কাছ থেকে বা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কাশ কিনে নেন,' বলেন তিনি।

কুড়িগ্রাম চর উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বেবু জানান, 'কাশ এখন অঘোষিতভাবে চরাঞ্চলের অন্যতম অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। কৃষি বিভাগে এর কোনো আনুষ্ঠানিক হিসাব নেই, কিন্তু এর অর্থনৈতিক প্রভাব বিশাল।'

তিনি আরও বলেন, 'একসময় কাশের তেমন দাম ছিল না। কিন্তু গত ১০ থেকে ১২ বছরে পানচাষে ব্যবহারের কারণে চাহিদা অনেক বেড়েছে।'

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, 'অনেক চর পরিত্যক্ত হলেও সেখানে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে কাশ। প্রতিবছর জুন-জুলাইয়ে জন্মে নভেম্বরের মধ্যে পরিপক্ব হয়। কাশফুল যেমন প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়ায়, তেমনি চরের কৃষকদের জীবনেও নিয়ে আসে আর্থিক সচ্ছলতা।'

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


চরের চাষিদের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে বিনা খরচের ‘কাশবন’

নিউজ ভুবন ডেস্ক

প্রকাশিত: ৩০ অক্টোবর ২০২৫ ১১:১০ এএম

'চর মনতলা' ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে জেগে ওঠা ভূখণ্ড

ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে একখণ্ড ভূখণ্ড, যার নাম 'চর মনতলা'। এই চরের চাষিদের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে বিনা খরচের ‘কাশবন’।

একসময় ধুধু বালুচর ছিল এ অঞ্চল, যেখানে তেমন ফসল ফলত না। এখন সেই নির্জন বালুচরেই ফুটেছে কৃষকদের মুখে হাসি। কারণ, এখানে জন্ম নিচ্ছে 'বিনা খরচের ফসল' কাশ।

চরের চাষি নুরুল ইসলাম, খবির উদ্দিন, শামসুল মণ্ডল, আবির আলী ও লোকমান হোসেন—সবারই গল্প এক। কৃষিকাজে নানা অনিশ্চয়তার মধ্যেও তারা প্রতিবছর কাশ বিক্রি করেন। এ থেকে তাদের আয়ও বেশ, যা অন্য কোনো ফসল থেকেও মেলে না।

নুরুল ইসলাম জানান, তার চার একর জমির মধ্যে দুই একর এখন ধু ধু বালুচর। সেখানেই প্রাকৃতিকভাবে জন্মেছে কাশ। 'কাশের জন্য কোনো সার, কীটনাশক বা পরিচর্যা লাগে না,' বলেন তিনি। 'শুধু কাটার সময় শ্রমিকদের খরচ দিতে হয়। প্রতি একরে খরচ হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।'

তিনি জানান, গত বছর দুই বিঘা জমি থেকে প্রায় ৫০ হাজার আঁটি কাশ সংগ্রহ করে আট থেকে ১০ টাকা দরে বিক্রি করেছিলেন। মোট বিক্রি করেছিলেন চার লাখ ৫০ হাজার টাকার কাশ। চোখে আনন্দের ঝিলিক নিয়ে নুরুল বলছিলেন, 'এই ফসল সত্যিই আমাদের আশীর্বাদ।'

লোকমান হোসেন জানান, তার চার বিঘা বালুচর জমিতেও কাশবাগান হয়েছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি কাশ কাটা শুরু হবে। তিনি বলেন, 'বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকার এসে কাশ কিনে নিয়ে যান। পানচাষে কাশের চাহিদা অনেক। দামও ভালো পাই।'

লালমনিরহাটের ধরলা নদীপাড়ের চর ফলিমারীর কৃষক সিরাজুল ইসলাম জানান, গত বছর দুই বিঘা জমির কাশ বিক্রি করে পেয়েছিলেন এক লাখ ৩০ হাজার টাকা, খরচ হয়েছিল ৩৫ হাজার। এবার তার চার বিঘা জমিতে কাশবাগান হয়েছে। 'একজন ব্যবসায়ী আগেই আমাকে ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছেন। কাশ এখন অনেক চরের কৃষকের মুখে হাসি এনে দিয়েছে।'

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার ও ধরলা নদীর চরে তিন শতাধিক কাশবাগান রয়েছে, যেখানে প্রায় ৫৫০টি চরের মধ্যে অধিকাংশই কাশ উৎপাদনের উপযোগী। প্রতিটি বাগান ৫ থেকে ২০ একর পর্যন্ত বিস্তৃত। এসব চরে প্রতিবছর উৎপাদিত হয় প্রায় ৯ থেকে ১০ কোটি আঁটি কাশ। নভেম্বরের মাঝামাঝি কাটা শুরু হয়ে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে বিক্রি। নদীপাড়ের এসব কাশ নৌকা ও ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়।

চিলমারীর জোড়গাছ এলাকার কাশ ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান জানান, প্রতিবছর ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পাড়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকার কাশের ব্যবসা হয়। 'আমরা অনেক চাষিকে অগ্রিম টাকা দিই। দেশের নানা প্রান্তের পাইকাররা আমাদের কাছ থেকে বা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কাশ কিনে নেন,' বলেন তিনি।

কুড়িগ্রাম চর উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বেবু জানান, 'কাশ এখন অঘোষিতভাবে চরাঞ্চলের অন্যতম অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। কৃষি বিভাগে এর কোনো আনুষ্ঠানিক হিসাব নেই, কিন্তু এর অর্থনৈতিক প্রভাব বিশাল।'

তিনি আরও বলেন, 'একসময় কাশের তেমন দাম ছিল না। কিন্তু গত ১০ থেকে ১২ বছরে পানচাষে ব্যবহারের কারণে চাহিদা অনেক বেড়েছে।'

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, 'অনেক চর পরিত্যক্ত হলেও সেখানে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে কাশ। প্রতিবছর জুন-জুলাইয়ে জন্মে নভেম্বরের মধ্যে পরিপক্ব হয়। কাশফুল যেমন প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়ায়, তেমনি চরের কৃষকদের জীবনেও নিয়ে আসে আর্থিক সচ্ছলতা।'

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর