মুঘল আমলের মসজিদ কারওয়ান বাজারে
মুঘল আমলে নির্মিত খাজা আম্বর শাহ মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে ঢাকার প্রানকেন্দ্র কারওয়ান বাজারে।
ঢাকার কারওয়ান বাজারে মেট্রোরেলের স্টেশনের ঠিক পূর্বপাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি মসজিদ। পলেস্তারার ওপর বাদামী রঙে ঢাকা থাকায় প্রথম দেখায় ঠাহর করা যায় না এর বয়স কত হতে পারে। এটি মুঘল আমলের অনন্য স্থাপত্যকীর্তি—খাজা আম্বর শাহ মসজিদ।
মাটির স্তর থেকে প্রায় ১২ ফুট উঁচুতে একটি বেদীর ওপর নির্মিত তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি। ধারণা করা হয়, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে সুবেদার শায়েস্তা খানের শাসনামলে তার এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী খাজা আম্বর শাহ এটি নির্মাণ করেন।
কাঁচে মোড়ানো আধুনিক সব ভবনের ভিড়ে মুঘল জৌলুসের এই স্মৃতিচিহ্নটি যেন ঢাকার সমৃদ্ধ অতীতের প্রতিধ্বনি।
মসজিদটির গম্বুজ, খিলান এবং অষ্টভুজাকৃতির কোণার টাওয়ারগুলোতে মুঘল কারুশিল্পের নান্দনিক কাজ দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। মসজিদের চার কোণে চারটি উঁচু মিনারসদৃশ কাঠামো রয়েছে, যার প্রতিটির মাথায় আছে ছোট গম্বুজ। পূর্ব দিকের একটি সিঁড়ি বেয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে হয়। মিহরাবের ওপরে পবিত্র কুরআনের আয়াত সংবলিত একটি পাথরের শিলালিপি দেখা যায়। মসজিদের কেন্দ্রীয় প্রবেশদ্বারের ওপরে আরেকটি শিলালিপিতে শায়েস্তা খানের নাম এবং নির্মাণকাল উল্লেখ রয়েছে।
এই মসজিদের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে একটি মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসার শিক্ষক মুফতি তায়েব আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, 'শিলালিপিটি পুরোনো ফার্সি ভাষায় লেখা। সময়ের সাথে সাথে এর কিছু অংশ অস্পষ্ট হয়ে গেছে। এখন মাত্র কয়েকটি লাইন পড়া যায়। তবে দ্বিতীয় লাইনে শায়েস্তা খানের নামটি স্পষ্ট বোঝা যায়।'
তিনি জানান, ধারণা করা হয়, শায়েস্তা খান যখন বাংলার সুবেদার হিসেবে প্রথম মেয়াদে (১৬৬৪-১৬৬৮) ছিলেন, সেই সময়েই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। তখন দিল্লির মসনদে ছিলেন আওরঙ্গজেব।
মসজিদটিতে বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। এর কাঠামো খুবই মজবুত, যার পুরু দেয়াল ও গম্বুজ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে আছে। মূল মসজিদের পেছনে বর্তমানে পাঁচতলা কমপ্লেক্সে মার্বেলের মেঝে, মোজাইক করা স্তম্ভ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ এবং আলোকসজ্জাসহ আধুনিক সব সুযোগসুবিধা রয়েছে।
তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মূল মসজিদটির নিচে একটি বেসমেন্ট রয়েছে, যা একসময় গুদাম, শয়নকক্ষ এবং এমনকি মাদ্রাসা ছাত্রদের রান্নার জায়গা হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, মসজিদটি এমন এক সময়ে নির্মিত হয়েছিল যখন কারওয়ান বাজার ছিল ঢাকা শহরের একটি প্রান্তে হাতিরঝিলের জলপথের কাছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা ভ্রমণকারীরা এখানে তাদের নৌকা নোঙর করতেন এবং যাত্রাপথের বিরতিতে মসজিদে বিশ্রাম নিতেন। কালের পরিক্রমায় কারওয়ান বাজার এখন ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হয়েছে।
১৯৬৭ সাল থেকে মসজিদের পাশে ব্যবসা করছেন আবদুস সালাম। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, মসজিদের উত্তর দিকে দেয়ালঘেরা খাজা আম্বর শাহের মাজার দেখেছেন তিনি। তিনি বলেন, 'মসজিদের পাশে একই সময়ে নির্মিত একটি কূপও ছিল, যেখান থেকে মুসল্লিরা অজু করতেন।'
তিনি আরও জানান, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ সংলগ্ন মসজিদের পূর্ব দিকে একসময় একটি খোলা নামাজের শেড ছিল। পরে এরশাদ সরকারের আমলে এটি ভেঙে একটি বাগান তৈরি করা হয়, যা এখনো আছে।
১৯৯০-এর দশকে কারওয়ান বাজারের চারপাশে বাণিজ্যিক বহুতল ভবন গড়ে উঠতে শুরু করলে মুসল্লিদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। স্থান সংকুলানের জন্য মসজিদ কমিটি একটি বহুতল সম্প্রসারণ প্রকল্প হাতে নেয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ এই পরিকল্পনা অনুমোদন করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি পাঁচতলা মসজিদ ভবন নির্মাণ করা হয়। মসজিদের দক্ষিণ পাশে নির্মাণ করা হয় একটি সাততলা মাদ্রাসা ভবন। এর নিচতলায় বেশ কয়েকটি ছোট দোকান ও একটি রেস্তোরাঁ আছে। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের মতে, দোকান ভাড়া থেকে যা আয় হয় তা মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং শিক্ষামূলক কাজে ব্যয় করা হয়।
মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্র শহিদুল ইসলাম বলেন, 'মসজিদের ধারণক্ষমতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এখন চার হাজারের বেশি মুসল্লি একত্রে নামাজ পড়তে পারেন।'
মসজিদটি সম্প্রসারণ করে আয়তন বাড়ানো হলেও তিন গম্বুজ বিশিষ্ট পুরোনো অংশটি তার ঐতিহাসিক স্বকীয়তা ধরে রেখেছে। এর টেরাকোটা, খিলানের প্রবেশদ্বার এবং প্রাচীন শিলালিপি ঢাকার সমৃদ্ধ অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: