newsbhuban25@gmail.com মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫
৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

নরওয়ের কবি 'ভেরা সিদার' লোকগানের স্কুল

নিউজ ভুবন ডেস্ক প্রকাশিত: ২১ অক্টোবর ২০২৫ ১১:১০ এএম

লোকসংগীতের স্কুল

মায়ের তরী গুরুগৃহের শিশুদের সঙ্গে আড্ডায় কবি ও গবেষক ভেরা সিদার। গত ১৯ মে কুড়িগ্রামের রাজারহাটের ছিনাই ইউনিয়নের শিতলীরপাঠ গ্রামে।

নরওয়ের কবি ও গবেষক ভেরা সিদার (৮০)। প্রায় তিন দশক আগে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। গিয়েছিলেন কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার উত্তর নামাজের চর এলাকায়, বন্যাদুর্গত মানুষের জীবন দেখতে। তখন চরের নারীদের গাওয়া গানের সুর তাঁকে মুগ্ধ করে। বাংলার লোকগানের প্রেমে পড়েন তিনি।

এরপর কেটে যায় অনেকটা সময়। কিন্তু বাংলার লোকগানের প্রতি ভেরা সিদারের ভালোবাসা কমেনি, বরং বেড়েছে। নিজেই নরওয়েজিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছেন বাংলার মরমি সাধক ফকির লালন সাঁইয়ের গান। বাংলার লোকগানকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ২০১৬ সালে তিনি ‘মায়ের তরী’ নামের সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন।

‘মায়ের তরী’ কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের ৯টি কেন্দ্রে শিশু-কিশোরদের লোকগান ও বাদ্যযন্ত্র শেখাচ্ছে। এখানে ৬০০ শিশু লালন, বাউল, মারফতি, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়াসহ নানা ধরনের লোকগান শিখছে। পাশাপাশি শিখছে বাঁশি, একতারা, দোতারা, তবলা, বেহালা ও ঢোল বাজানো।

অস্থির সময়ে লোকসংগীতই পারে মানুষকে স্থির ও মানবিক করতে—‘মায়ের তরী’ গড়ে তোলার সময় এই ভাবনা ছিল ভেরা সিদারের মনে। তাঁদের গুরুগৃহের কার্যক্রম দেখতে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের শিতলীরপাঠ গ্রামে যাওয়া।

শনিবার ভোরের আলো ফুটতেই শিতলীরপাঠ গ্রামের শিশুরা হাতে একতারা নিয়ে ছুটছিল গুরুগৃহের দিকে। দূরে ‘মায়ের তরী’ গুরুগৃহ থেকে ভেসে আসছিল সুর—‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, শিশুরা কেউ গান গাইছে। কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। হারমোনিয়াম ও তবলায় তাল দিচ্ছিলেন গুরু নারায়ণ চন্দ্র রায় ও তাঁর সহযোগীরা।

নারায়ণ চন্দ্র রায় বলেন, এখানে শিতলীরপাঠ ও আশপাশের গ্রামের প্রান্তিক পরিবারের শিশুরা বিনা খরচে লোকগান ও বাদ্যযন্ত্র শেখে। এখানকার অনেক শিক্ষার্থী এখন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীতে পড়াশোনা করছে। শহরে শিশুরা গানবাজনা শেখার সুযোগ পেলেও প্রান্তিক শিশুরা এসব থেকে বঞ্চিত থাকে। তাদের জীবনে গানের সুর-তাল ছড়িয়ে দিচ্ছে ‘মায়ের তরী’।

‘মায়ের তরী’র সমন্বয়ক ইউসুফ আলমগীর বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে নরওয়ের লেখক ও আলোকচিত্রী ভেরা সিদারের জড়িয়ে পড়ার গল্পটি শোনালেন। তিনি বলেন, ভেরা ১৯৯৮ সালে প্রথম বাংলাদেশে আসেন। তখন বন্যার্তদের দেখতে কুড়িগ্রামের এক চরে যান। চরের নারীদের মুখে শোনেন মারফতি ও মুর্শিদি গান। গানের কথা না বুঝলেও সুর তাঁর মর্মে গেঁথে যায়। সেই সুরে মুগ্ধ হয়ে বাংলার লোকগানের প্রেমে পড়েন। পরে স্থানীয় শিল্পী ও সংগঠকদের সঙ্গে নিয়ে ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মায়ের তরী’। লোকগানের প্রতি ভালোবাসা থেকে লালনগীতি অনুবাদে মন দেন। লালনের ৫৩টি গান নরওয়েজিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছেন। সেগুলো নিয়ে প্রকাশ করেছেন একটি বই। পরে চরের শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন ‘মায়ের তরী’।

আদুরী রানী, এক শিক্ষার্থীর মা
‘মায়ের তরী’র পরিচালক সুজন কুমার বেদের মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় পেশায় মনোবিজ্ঞানী ভেরা সিদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘লালনের গান অনুবাদ করা সহজ ছিল না। এর মধ্যে আছে আধ্যাত্মিকতা, মানবপ্রেম, সমাজ সমালোচনা। কিন্তু আমি চেয়েছি নরওয়ের মানুষ বুঝুক, বাংলার মাটিতে কেমন গভীর মানবতার সুর বেজে ওঠে। আজকের পৃথিবীতে মানসিক শান্তি পাওয়া কঠিন। মানুষ ছুটছে, কিন্তু কোথায় যাচ্ছে, তা জানে না। লোকসংগীত শুধু গান নয়, এটি একধরনের আত্মার চর্চা, যা মানুষকে মানুষ বানায়, প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যায়। আমি বিশ্বাস করি, লোকগান সেই অস্থিরতার প্রতিষেধক হতে পারে।’

‘মায়ের তরী’ চরের বিদ্যালয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করছে। শিশুদের জন্য তারা বিশেষভাবে তৈরি করেছে ‘লোকগান শিক্ষা কর্মসূচি’। এর আওতায় স্থানীয় শিল্পীরা প্রতি শুক্র ও শনিবার গুরুগৃহে গান ও বাদ্যযন্ত্রের বাজনা শেখান।

স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক মমতাজুল হক বলেন, ‘এই উদ্যোগের কারণে চরের মানুষ নিজের সংস্কৃতির গর্ব ফিরে পাচ্ছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা বুঝছে, লোকগান কোনো পুরোনো বা ফেলনা বিষয় নয়, এটাই আমাদের আত্মার ভাষা।’

চরের কোনো গ্রামে বসে সন্তানেরা গানবাজনা শিখতে পারবে, এটা একসময় এখানকার মানুষের কাছে অকল্পনীয় ছিল। ভেরা সিদারের উদ্যোগ সেটাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। ছিনাই ইউনিয়নের বাসিন্দা আদুরী রানীর তাই কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

লোকসংগীত শুধু গান নয়, এটি একধরনের আত্মার চর্চা, যা মানুষকে মানুষ বানায়, প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যায়। আমি বিশ্বাস করি, লোকগান সেই অস্থিরতার প্রতিষেধক হতে পারে।’
ভেরা সিদার, নরওয়ের কবি ও গবেষক
লালন বলেছেন, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। সেই মানুষ হয়ে ওঠাই তো সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলে মনে করেন সংগঠক ইউসুফ আলমগীর। তাঁর ভাষায়, ‘মানুষ যদি প্রকৃতিকে ভালোবাসে, তাহলে সে মানুষকেও ভালোবাসতে শেখে। আমাদের কাজ সেই ভালোবাসা ফিরিয়ে আনা। মায়ের তরী ঠিক সেই কাজই করে চলছে।’

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


নরওয়ের কবি 'ভেরা সিদার' লোকগানের স্কুল

নিউজ ভুবন ডেস্ক

প্রকাশিত: ২১ অক্টোবর ২০২৫ ১১:১০ এএম

লোকসংগীতের স্কুল

মায়ের তরী গুরুগৃহের শিশুদের সঙ্গে আড্ডায় কবি ও গবেষক ভেরা সিদার। গত ১৯ মে কুড়িগ্রামের রাজারহাটের ছিনাই ইউনিয়নের শিতলীরপাঠ গ্রামে।

নরওয়ের কবি ও গবেষক ভেরা সিদার (৮০)। প্রায় তিন দশক আগে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। গিয়েছিলেন কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার উত্তর নামাজের চর এলাকায়, বন্যাদুর্গত মানুষের জীবন দেখতে। তখন চরের নারীদের গাওয়া গানের সুর তাঁকে মুগ্ধ করে। বাংলার লোকগানের প্রেমে পড়েন তিনি।

এরপর কেটে যায় অনেকটা সময়। কিন্তু বাংলার লোকগানের প্রতি ভেরা সিদারের ভালোবাসা কমেনি, বরং বেড়েছে। নিজেই নরওয়েজিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছেন বাংলার মরমি সাধক ফকির লালন সাঁইয়ের গান। বাংলার লোকগানকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ২০১৬ সালে তিনি ‘মায়ের তরী’ নামের সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন।

‘মায়ের তরী’ কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের ৯টি কেন্দ্রে শিশু-কিশোরদের লোকগান ও বাদ্যযন্ত্র শেখাচ্ছে। এখানে ৬০০ শিশু লালন, বাউল, মারফতি, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়াসহ নানা ধরনের লোকগান শিখছে। পাশাপাশি শিখছে বাঁশি, একতারা, দোতারা, তবলা, বেহালা ও ঢোল বাজানো।

অস্থির সময়ে লোকসংগীতই পারে মানুষকে স্থির ও মানবিক করতে—‘মায়ের তরী’ গড়ে তোলার সময় এই ভাবনা ছিল ভেরা সিদারের মনে। তাঁদের গুরুগৃহের কার্যক্রম দেখতে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের শিতলীরপাঠ গ্রামে যাওয়া।

শনিবার ভোরের আলো ফুটতেই শিতলীরপাঠ গ্রামের শিশুরা হাতে একতারা নিয়ে ছুটছিল গুরুগৃহের দিকে। দূরে ‘মায়ের তরী’ গুরুগৃহ থেকে ভেসে আসছিল সুর—‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, শিশুরা কেউ গান গাইছে। কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। হারমোনিয়াম ও তবলায় তাল দিচ্ছিলেন গুরু নারায়ণ চন্দ্র রায় ও তাঁর সহযোগীরা।

নারায়ণ চন্দ্র রায় বলেন, এখানে শিতলীরপাঠ ও আশপাশের গ্রামের প্রান্তিক পরিবারের শিশুরা বিনা খরচে লোকগান ও বাদ্যযন্ত্র শেখে। এখানকার অনেক শিক্ষার্থী এখন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীতে পড়াশোনা করছে। শহরে শিশুরা গানবাজনা শেখার সুযোগ পেলেও প্রান্তিক শিশুরা এসব থেকে বঞ্চিত থাকে। তাদের জীবনে গানের সুর-তাল ছড়িয়ে দিচ্ছে ‘মায়ের তরী’।

‘মায়ের তরী’র সমন্বয়ক ইউসুফ আলমগীর বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে নরওয়ের লেখক ও আলোকচিত্রী ভেরা সিদারের জড়িয়ে পড়ার গল্পটি শোনালেন। তিনি বলেন, ভেরা ১৯৯৮ সালে প্রথম বাংলাদেশে আসেন। তখন বন্যার্তদের দেখতে কুড়িগ্রামের এক চরে যান। চরের নারীদের মুখে শোনেন মারফতি ও মুর্শিদি গান। গানের কথা না বুঝলেও সুর তাঁর মর্মে গেঁথে যায়। সেই সুরে মুগ্ধ হয়ে বাংলার লোকগানের প্রেমে পড়েন। পরে স্থানীয় শিল্পী ও সংগঠকদের সঙ্গে নিয়ে ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মায়ের তরী’। লোকগানের প্রতি ভালোবাসা থেকে লালনগীতি অনুবাদে মন দেন। লালনের ৫৩টি গান নরওয়েজিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছেন। সেগুলো নিয়ে প্রকাশ করেছেন একটি বই। পরে চরের শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন ‘মায়ের তরী’।

আদুরী রানী, এক শিক্ষার্থীর মা
‘মায়ের তরী’র পরিচালক সুজন কুমার বেদের মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় পেশায় মনোবিজ্ঞানী ভেরা সিদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘লালনের গান অনুবাদ করা সহজ ছিল না। এর মধ্যে আছে আধ্যাত্মিকতা, মানবপ্রেম, সমাজ সমালোচনা। কিন্তু আমি চেয়েছি নরওয়ের মানুষ বুঝুক, বাংলার মাটিতে কেমন গভীর মানবতার সুর বেজে ওঠে। আজকের পৃথিবীতে মানসিক শান্তি পাওয়া কঠিন। মানুষ ছুটছে, কিন্তু কোথায় যাচ্ছে, তা জানে না। লোকসংগীত শুধু গান নয়, এটি একধরনের আত্মার চর্চা, যা মানুষকে মানুষ বানায়, প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যায়। আমি বিশ্বাস করি, লোকগান সেই অস্থিরতার প্রতিষেধক হতে পারে।’

‘মায়ের তরী’ চরের বিদ্যালয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করছে। শিশুদের জন্য তারা বিশেষভাবে তৈরি করেছে ‘লোকগান শিক্ষা কর্মসূচি’। এর আওতায় স্থানীয় শিল্পীরা প্রতি শুক্র ও শনিবার গুরুগৃহে গান ও বাদ্যযন্ত্রের বাজনা শেখান।

স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক মমতাজুল হক বলেন, ‘এই উদ্যোগের কারণে চরের মানুষ নিজের সংস্কৃতির গর্ব ফিরে পাচ্ছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা বুঝছে, লোকগান কোনো পুরোনো বা ফেলনা বিষয় নয়, এটাই আমাদের আত্মার ভাষা।’

চরের কোনো গ্রামে বসে সন্তানেরা গানবাজনা শিখতে পারবে, এটা একসময় এখানকার মানুষের কাছে অকল্পনীয় ছিল। ভেরা সিদারের উদ্যোগ সেটাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। ছিনাই ইউনিয়নের বাসিন্দা আদুরী রানীর তাই কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

লোকসংগীত শুধু গান নয়, এটি একধরনের আত্মার চর্চা, যা মানুষকে মানুষ বানায়, প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যায়। আমি বিশ্বাস করি, লোকগান সেই অস্থিরতার প্রতিষেধক হতে পারে।’
ভেরা সিদার, নরওয়ের কবি ও গবেষক
লালন বলেছেন, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। সেই মানুষ হয়ে ওঠাই তো সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলে মনে করেন সংগঠক ইউসুফ আলমগীর। তাঁর ভাষায়, ‘মানুষ যদি প্রকৃতিকে ভালোবাসে, তাহলে সে মানুষকেও ভালোবাসতে শেখে। আমাদের কাজ সেই ভালোবাসা ফিরিয়ে আনা। মায়ের তরী ঠিক সেই কাজই করে চলছে।’

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর