যশোরের ৬টি আসনে বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থী যারা
যশোরের ছয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটিতে বিএনপি দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে চারটিতেই প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য স্থানীয় বিএনপির একটি অংশের নেতারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। এমন অবস্থায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রেখে নির্বাচনে অংশ নেওয়া এখন বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। পাশা-পাশি আশা জাগিয়ে রাখছে জামায়াত।
চূড়ান্ত মনোনয়ন ঘোষণা হলে দলে বিরোধ থাকবে না বলে দাবি করেছেন বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম (অমিত)। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, বিএনপি বড় একটি রাজনৈতিক দল। সেই দলে প্রতিটি আসনে একাধিক যোগ্য প্রার্থী রয়েছেন। যোগ্যদের সবাই মনোনয়ন দাবি করবে এটাই স্বাভাবিক। চূড়ান্ত মনোনয়ন প্রকাশের পর প্রতিটি এলাকায় বর্ধিত সভা করে ধানের শীষ প্রতীক জয়ী করার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করা হবে। দলের মধ্যে কোথাও কোনো বিরোধ থাকবে না।
জেলার ছয়টি আসনেই প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে আগেভাগে প্রচার-প্রচারণায় নেমেছে জামায়াত। জেলা জামায়াতের আমির মো. গোলাম রসুলের মতে, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের ভোটের হিসাব দিয়ে ২০২৪ সালের জামায়াতকে বিচার করলে হবে না। মানুষের চিন্তাচেতনায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। তরুণেরা পরিবর্তন চান।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনো দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি। তবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তাঁদের অনেকেই কমবেশি গণসংযোগ করছেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে জেলার পাঁচটি আসনে আওয়ামী লীগ ও একটিতে জামায়াতের প্রার্থী জয়ী হন। ১৯৯৬ সালে সব কটি আসনে জয় পায় আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালে দুটিতে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ, জামায়াত, জাতীয় পার্টি (নাজিউর) ও জমিয়তে উলামা ইসলাম একটি করে আসন পায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ছয়টি আসনেই আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন।
যশোর-১ (শার্শা)
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আলী কদর এ আসনে জয়ী হয়েছিলেন। এরপর ২০০৮ সালে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোটের প্রার্থী হন জামায়াতের নেতা মাওলানা আজীজুর রহমান। পাঁচ হাজার ভোটের ব্যবধানে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে হেরে যান। এবারও আজীজুর রহমানকে জামায়াতের দলীয় প্রার্থী করা হয়েছে। এ জন্য জামায়াতে ইসলামী এ আসনে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। যদিও বিএনপি নেতাদের দাবি, জামায়াতের প্রার্থী ২০০৮ সালে যে ভোট পেয়েছিলেন, তা ছিল মূলত বিএনপির ভোট।
এ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে গণসংযোগ করছেন দলের সাবেক দপ্তর সম্পাদক মফিকুল হাসান (তৃপ্তি)। যদিও শার্শার কয়েকটি ইউনিয়নের একাংশের নেতারা প্রার্থী বদলের জন্য কেন্দ্রে লিখিত আবেদন করেছেন। শার্শা উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. হাসান জহির, সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লিটন ও সাবেক সভাপতি খাইরুজ্জামান এ আসনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী।
এ বিষয়ে মো. হাসান জহির বলেন, ‘কোনো ত্যাগী নেতাকে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান। এ জন্য বিভিন্ন ইউনিয়নের নেতারা লিখিত আবেদন জানিয়েছেন।’
বিএনপির দলীয় প্রার্থী মফিকুল হাসান বলেন, ‘উপজেলা বিএনপির সভাপতি হাসান জহির এখনো বিরোধিতা করছেন। তিনি কাউকে কাউকে দিয়ে আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছেন। তবে তাদের অনেকে আবার আমার সঙ্গে নির্বাচনী গণসংযোগে মাঠে কাজ করছেন।’
যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা)
এ আসনে বিএনপির প্রার্থী দলের ঝিকরগাছা উপজেলার সভাপতি সাবিরা সুলতানা। তিনি খুলনা বিভাগে দলের একমাত্র নারী প্রার্থী। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে এ আসন থেকে জামায়াতের নেতা মোহাদ্দিস আবু সাঈদ নির্বাচিত হন। এবার জামায়াত এখানে প্রার্থী করেছে মোসলেহ উদ্দিন ফরিদকে।
আসটিতে বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে ইতিমধ্যে দলের নেতাদের একটি অংশ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান এ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন চান। তিনি বলেন, সাবিরা সুলতানা নারী প্রার্থী হওয়ায় অনেক ভোট জামায়াতের বক্সে চলে যেতে পারে। এ জন্য তৃণমূল বিএনপির নেতারা প্রার্থী বদলের জন্য লিখিত আবেদন করেছেন।
সাবিরা সুলতানা বলেন, ‘আমি নারী প্রার্থী হওয়ায় নারীদের ভোট আমার বক্সে টেনে আনা আরও সহজ হবে।’
যশোর-৩ (সদর)
জেলার একমাত্র এ আসনে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের খবর পাওয়া যায়নি। আসনটিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও মন্ত্রী প্রয়াত তরিকুল ইসলামের প্রভাব রয়েছে। এখন তাঁর ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁর বিপরীতে দলের কোনো নেতা মনোনয়ন চাননি।
বিএনপির প্রার্থী অনিন্দ্য ইসলাম বলেন, ‘আমি মনে করি, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। যশোরের মানুষের যেকোনো প্রয়োজনে, সমস্যা-সম্ভাবনা, সুখে-দুঃখে আমি সার্বক্ষণিক পাশে ছিলাম, আছি এবং থাকব। যেকোনো রাজনীতিকের তুলনায় আমি এখানকার জনমানুষের সঙ্গে একটু বেশি সম্পৃক্ত। এ কারণে মানুষ আমাকে ভোট দেবে।’
জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে প্রচারণ-প্রচারণায় আছেন দলের জেলা শাখার রোকন আবদুল কাদের। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের সবাই জয়ের বিষয়ে আশাবাদী থাকেন। আমিও আশাবাদী। মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে এবার ভোট দিতে চায়।’
যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর এবং সদরের বসুন্দিয়া ইউনিয়ন)
আসনটিতে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন তিনজন। এর মধ্যে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য টি এস আইয়ুবকে। জেলা জামায়াতের আমির মো. গোলাম রসূলকে এ আসন থেকে আগেই দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি নিয়মিত গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ আসনেও বিএনপির মধ্যে বিরোধ রয়েছে। অভয়নগর বিএনপির সভাপতি মতিয়ার রহমান ফারাজি দলীয় মনোনয়ন চান। ইতিমধ্যে তাঁর অনুসারীরা দলীয় প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া নৌবন্দর এলাকায় মানববন্ধন করেছেন। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে লিখিত আবেদনও করেছেন।
মতিয়ার রহমান বলেন, ‘বরাবরই বাঘারপাড়া উপজেলা থেকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অভয়নগর থেকে কখনো বিএনপির কোনো প্রার্থী করা হয়নি। এ জন্য অভয়নগরবাসীর দাবি এবার এই উপজেলা থেকে আমাকে প্রার্থী ঘোষণা করা হোক। এ ছাড়া টি এস আইয়ুবের বিরুদ্ধে ঋণখেলাপির মামলা রয়েছে।’
এ ব্যাপারে বিএনপির প্রার্থী টি এস আইয়ুব বলেন, ‘বিএনপির রাজনীতি করার কারণে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দেওয়া ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়েছি। এলাকায় থাকতে পারিনি। গত ১৫ বছর কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুই করতে পারেনি। ঋণ খেলাপি হবে, এটা স্বাভাবিক। তবে সেসব এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। এখন আমি আর ঋণখেলাপি নই।’
যশোর-৫ (মনিরামপুর)
শরিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে বিভিন্ন সময় এ আসনে ছাড় দিয়ে আসছে বিএনপি। এবারও আসনটিতে এখনো দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। এখানে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে মাঠে সক্রিয় আছেন আইনজীবী গাজী এনামুল হক।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রার্থী ছিলেন মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস। তিনি ২০০১ সালের ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে আসনটিতে জয়ী হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর এখন এ আসনে তাঁর ছেলে রশিদ বিন ওয়াক্কাস প্রার্থী হতে চান।
এদিকে বিএনপির স্থানীয় নেতৃত্ব এ আসন শরিক দলের কাছে ছাড়তে নারাজ। দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি শহীদ ইকবাল হোসেন দাবি করেন, ‘শরিক দলের প্রার্থীর অনুকূলে এ আসন এবার ছেড়ে দিলে জিতে আসা খুব কঠিন হবে।’
যশোর-৬ (কেশবপুর)
এবার দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির বড় চমক দেখিয়েছে যশোর-৬ আসনে। তরুণ মুখ হিসেবে ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলামকে প্রার্থী করেছে বিএনপি। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির এই সদস্য দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী বলে জানিয়েছেন তিনি।
এ আসনে রওনকুল ইসলামের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে সক্রিয় আছেন তাঁরই শিক্ষক জামায়াতে ইসলামীর নেতা মো. মোক্তার আলী। তিনি কেশবপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
আসটিতে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পরও দলীয় কোন্দল মেটেনি। উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল হোসেন আজাদ দলীয় মনোনয়ন চান। প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য তাঁর অনুসারীরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন।
কাজী রওনকুল ইসলাম দাবি করেন, ‘ক্লিন ইমেজের মানুষ হিসেবে আমাকে কেশবপুরের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছে। বিএনপি নেতা আবুল হোসেন আজাদ দীর্ঘদিন এই উপজেলায় রাজনীতি করছেন। দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় তাঁর মন খারাপ হয়েছে। তবে তিনি খুব দ্রুতই আমার পক্ষে ধানের শীষ প্রতীককে জয়ী করতে মাঠে নামবেন বলে আমি আশাবাদী।’

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: