newsbhuban25@gmail.com মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫
৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন শেখ পরিবার, দুদকের মামলা

নিউজ ভুবন ডেস্ক প্রকাশিত: ১৮ নভেম্বর ২০২৫ ১১:১১ এএম

দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন শেখ পরিবারের সদস্যবৃন্দ

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আওতায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবার ও তার বোন শেখ রেহানার পরিবারের বিরুদ্ধে ১৫টির বেশি মামলা দায়ের হয়েছে। চলছে অনিয়ম সংক্রান্ত মামলার তদন্ত কাজও।

এক বছরের ব্যবধানে শেখ পরিবারে বিরুদ্ধে প্লট, সেতুর টোল, সূচনা ফাউন্ডেশন, সিআরআইর অনুদান ও অবৈধ সম্পদের হাজার কোটি টাকার মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে।

শেখ হাসিনা ও তার পরিবার সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, দুদক নির্দিষ্ট কোনো বিষয় বা ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়ে কাজ করে না। দুদক আইন ও বিধি অনুসরণ করে তফসিলভুক্ত সব দুর্নীতির বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়। এক্ষেত্রেও দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা আইন ও বিধির মধ্যে থেকে তাদের তদন্তকাজ শেষ করবে। পরে আইনি পদক্ষেপ আদালত নেবে।

শেখ হাসিনাসহ পরিবার সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যত মামলা-

পূর্বাচলে ৬০ কাঠা প্লট নিয়ে আসামি শেখ পরিবার
রাজধানীর পূর্বাচলে ৬০ কাঠা প্লট বরাদ্দ নেওয়ার প্রমাণ পাওয়ায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে পুতুল ও তার বোন শেখ রেহানার পরিবারে সদস্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব সালাউদ্দিন এবং জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক ৮ অভিযোগপত্র বা চার্জশিট দাখিল করে দুদক। এর মধ্যে নিজ নামে পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর রাস্তার ৯ নম্বর প্লট নেওয়ার অভিযোগ শেখ হাসিনাসহ ১২ জনকে আসামি করে চার্জশিট দেওয়া হয় গত ১০ মার্চ। সব মামলা বর্তমানে বিচারাধীন পর্যায়ে রয়েছে। চলতি বছরেও রায় হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

গত ১২, ১৩ ও ১৪ জানুয়ারি তাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছিল। আসামিদের বিরুদ্ধে সরকারের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ও পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে বহাল থাকাকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের ওপর অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করে বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও অসৎ উদ্দেশ্যে পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর রাস্তার ৬টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ দুদক থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা গত ২৭ ডিসেম্বর জানিয়েছিল দুদক।

সেতুর টোলের ৩০৯ কোটি টাকা নয়-ছয়
মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায়ে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেডকে কাজ দিয়ে সরকারের প্রায় ৩০৯ কোটি ৪২ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি সাধনের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক মন্ত্রী কাদের ৭ মন্ত্রীসহ মোট ১৭ জনের বিরুদ্ধে গত ১২ অক্টোবর মামলা দায়ের করে দুদক। দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংস্থাটির সহকারী তানজিল বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

এ মামলায় আসামিরা হলেন— সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, সাবেক সচিব এম এ এন ছিদ্দিক, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফারুক জলিল, সাবেক উপসচিব মোহাম্মদ শফিকুল করিম, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. ফিরোজ ইকবাল, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান, সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আফতাব হোসেন খান, সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুস সালাম, সিএনএস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনীর উজ জামান চৌধুরী, পরিচালক সেলিনা চৌধুরী ও পরিচালক ইকরাম ইকবাল।

মামলা এজাহারে বলা হয়, ২০১৬ সালে মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায়ে দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেডে একক উৎসভিত্তিক দরপত্রে নিয়োগ দিতে পূর্বের টেন্ডার বাতিল করা হয়। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই শুধু সিএনএস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে ৫ বছরের জন্য সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করা হয় মোট আদায় করা টোলের ১৭.৭৫ শতাংশ। এর ফলে সিএনএস লিমিটেড মোট ৪৮৯ কোটি ৪৩ লাখ ৭৩ হাজার টাকা বিল গ্রহণ করে, যা একই মেয়াদের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক বেশি।

সেতুতে ২০১০-২০১৫ এই ৫ বছরে MBEL-ATT এই দুটি কোম্পানিকে জয়েন্ট ভেঞার কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে টোল আদায়ের ১৫ কোটি ৫৮ লাখ ৬৭ হাজার ৯১২ টাকায় নিয়োগ করা হয়। অথচ ২০২২-২০২৫ সালে মেঘনা-গোমতী সেতুতে ৩ বছরে ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে ভ্যাট ও আইটিসহ ৬৭ কোটি ৫৪ লাখ ৯১ হাজার ৪৬৬ টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয়। যা ৫ বছরে রূপান্তর করলে হয় ১১২ কোটি ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ১১০ টাকা। অতএব এমন নিয়োগের ফলে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৩০৯ কোটি ৪২ লাখ ৪৫ হাজার ৮৯০ টাকা।

জয়ের ৬০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ
৬০ কোটি ১৪ লাখ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও পাচারের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে গত ১৪ আগস্ট।

ওই মামলায় বলা হয়, স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে সজীব ওয়াজদ জয়ের মোট ৬১ কোটি ৪৬ লাখ ৮২ হাজার ৫১২ টাকার সম্পদের তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে তার ১ কোটি ৩২ লাখ ৮৬ হাজার ৪৮১ টাকার সম্পদের গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাকি ৬০ কোটি ১৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭০ টাকার সম্পদ জ্ঞাত আয় বহির্ভূতভাবে অর্জন করেছেন। এ অবৈধ সম্পদের মধ্যে তিনি অসাধু উপায়ে অর্থ পাচার করে আমেরিকাতে দুটি বাড়ি ৫৪ কোটি ৪ লাখ ৩২ হাজার ২৫৮ টাকায় ক্রয় করেন। জয় বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ায় আয়কর আইন মতে তার দেশ-বিদেশে অর্জিত ও অবস্থিত সম্পদের ঘোষণা আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক। তা সত্ত্বেও তিনি তার আয়কর নথিতে প্রদর্শন না করে দেশ থেকে বিদেশে অসাধু উপায়ে পাচার করে এবং নিজ নামের ২টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৫৭ কোটি ৫০ লাখ ৫৪ হাজার ৩১৫ টাকা সন্দেহজনক লেনদেন করেন।

সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে ৪৪৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ
সূচনা ফাউন্ডেশনের অনুকূলে অর্থ প্রদান ও কর ফাঁকির মাধ্যমে প্রায় ৪৪৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং প্রায় ৯৩১ কোটি টাকার মানিলন্ডারিংয়ের অপরাধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ১১ ট্রাস্টি, সালমান এফ রহমান ও আজিজ খানসহ ৮ ব্যবসায়ী এবং এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যানসহ ১৬ জন সদস্যদের বিরুদ্ধে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে মামলা করে দুদক।

দুদক বলছে, সূচনা ফাউন্ডেশন নামীয় নামসর্বস্ব ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে আসামিরা আয়কর আইনের ক্ষমতার অপব্যবহার কর মওকুফ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেন। যার মাধ্যমে তারা ৪৪৭ কোটি ৯৫ লাখ ৩০ হাজার ১৯৩ টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। এছাড়া ২০১৫–১৬ করবর্ষ থেকে ২০২৪–২৫ পর্যন্ত করবর্ষে মোট ৯৯ লাখ ৪ হাজার ৫৩১টাকা আয়কর প্রদান না করে প্রতারণা ও জাল জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন আর্থিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বা বিনিময়ে অবৈধ পারিতোষিক গ্রহণ করে সূচনা ফাউন্ডেশন নামীয় প্রতিষ্ঠানের ১৪টি ব্যাংক হিসাবে জমা ও উত্তোলনের মাধ্যমে মোট ৯৩০ কোটি ৯৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৫৯ টাকা লেনদেন করে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ করেছেন আসামিরা।

ওই মামলার আসামিরা হলেন, সূচনা ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ট্রাস্টি ও চেয়ারপার্সন প্রফেসর ডা. মাজহারুল মান্নান, ট্রাস্টি ও সাবেক ক্রীড়া মন্ত্রী মো. নাজমুল হাসান পাপন, ট্রাস্টি সায়ফুল্লাহ আব্দুল্লা সোলেনখী, সূচনা ফাউন্ডেশনের ট্রেজারার মো. শামসুজ্জামান, ট্রাস্টি জ্যান বারী রিজভী, ভাইস চেয়ারম্যান প্রফেসর প্রাণ গোপাল দত্ত, এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য প্রফেসর রুহুল হক, শিরিন জামান মুনির, এম এস মেহরাজ জাহান ও সদস্য ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

এছাড়া হামিদ রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যান ইন্তেকাবুল হামিদ, সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান ওরফে সালমান এফ রহমান, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আজিজ খান, সাবেক এমপি এ কে এম রহমাতুল্লাহ, ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান মঈন উদ্দীন হাসান রশিদ, মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ও বিল ট্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান এনায়েতুর রহমান।

অন্যদিকে এনবিআরের আসামিরা হলেন— সাবেক মুখ্যসচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, এনবিআর সাবেক সদস্য (কর অডিট, ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন) মীর মুস্তাক আলী, সাবেক সদস্য (ইন্টারন্যাশনাল ট্যাক্সসেস) চৌধুরী আমির হোসেন, সাবেক সদস্য (কর নীতি) পারভেজ ইকবাল, সাবেক সদস্য (শুল্ক নীতি) মো. ফরিদ উদ্দিন, সাবেক সদস্য (শুল্ক নিরীক্ষা) ফিরোজ শাহ আলম, সাবেক সদস্য (মূসক নীতি) ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন, সাবেক সদস্য (লিগ্যাল) ডা. মাহবুবুর রহমান, সাবেক সদস্য (কর তথ্য ব্যবস্থাপনা ও সেবা) লোকমান চৌধুরী, সাবেক সদস্য (মূসক) রেজাউল হাসান, সাবেক সদস্য (কর জরিপ ও পরিদর্শন) জিয়া উদ্দিন মাহমুদ, সাবেক সদস্য (কর প্রশাসন) আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক সদস্য (শুল্ক রপ্তানি ও বন্ড) এ এফ এম শাহরিয়ার মোল্লা ওরফে আবু ফয়সাল মো. শাহরিয়ার মোল্লা, সাবেক সদস্য (শুল্ক ও ভ্যাট শাখা) সুলতান মো. ইকবাল, সদস্য (বোর্ড প্রশাসন) তন্দ্রা সিকদার এবং সাবেক সদস্য (কর আপিল ও অব্যাহতি) কালিপদ হালদার।

সূচনা ফাউন্ডেশনের আরও ৩৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস ভুক্ত ব্যাংকের সিএসআর খাত থেকে সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে ৩৩ কোটি টাকা সহায়তার নামে আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে গত ২০ মার্চ মামলা করে দুদক।

ওই মামলায় সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে সিএসআর ফান্ড থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে ২০১৭ সালের মে মাসে ২০টি ব্যাংক থেকে ৩৩ কোটি ৫ লাখ টাকা সূচনা ফাউন্ডেশনের অনুকূলে প্রদানের জন্য বাধ্য করার অভিযোগ আনা হয়।

সিআরআইর অনুদানের ৪৩৯ কোটি টাকা লেনদেন
জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের অনুদানের নামে আত্মসাৎ, কর ফাঁকি ও ৪৩৯ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) চেয়ারম্যান জয়, তার মেয়ে পুতুল, শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান ও সাবেক অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামালসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয় গত ৬ নভেম্বর।

ওই মামলায় আসামিরা হলেন— সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা এবং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) চেয়ারম্যান সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয়, ট্রাস্টি ও ভাইস চেয়ারম্যান সায়মা হোসেন ওরফে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ রেহানার ছেলে ও ট্রাস্টি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল, ট্রাস্টি ও সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ (বিপু), এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর শাব্বির বিন শামস, সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া এবং সাবেক সদস্য (কর আপিল) রওশন আরা আক্তার।

মামলায় বলা হয়, জনকল্যাণের নামে প্রতিষ্ঠিত “সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) অনুকূলে ৪৫ কোটি ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ২৩টি কোম্পানির কাছ থেকে অবৈধভাবে অনুদান হিসেবে সংগ্রহ করে। যার মধ্যে ১৫ কোটি ৬৮ লাখ ৫৯ হাজার ৫২১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া সিআরআইয়ের নামে পরিচালিত ২৫টি ব্যাংক হিসাবে ২৪৭ কোটি ৮৫ লাখ ৩৬ হাজার ১৭০ টাকা জমা এবং ১৯১ কোটি ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৩০৯ টাকা উত্তোলনসহ মোট ৪৩৯ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে দুদক।

টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে প্লট দুর্নীতির মামলা
ঢাকার গুলশানের একটি প্লট ‘অবৈধভাবে হস্তান্তরের ব্যবস্থা’ করিয়ে দিয়ে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের কাছ থেকে ‘ঘুষ’ হিসেবে একটি ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও যুক্তরাজ্যের এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গত ১৫ এপ্রিল মামলা করে সংস্থাটি। মামলায় টিউলিপ সিদ্দিকসহ রাজউকের দুই কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়।

ওই মামলার এজাহারে বলা হয়, ১৯৬৩ সালে তৎকালীন বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী গুলশানে ১ বিঘা ১৯ কাঠা ১৩ ছটাক আয়তনের একটি প্লট বরাদ্দ পান। সরকারি ইজারা চুক্তি অনুযায়ী, ৯৯ বছরের মধ্যে ওই প্লট হস্তান্তর বা ভাগ করে বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল। তবে ১৯৭৩ সালে তিনি মজিবুর রহমান ভূঁইয়াকে আমমোক্তার মাধ্যমে প্লটটি হস্তান্তর করেন। এরপর প্লটটি ভাগ হয়ে বিক্রি হয় এবং ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলামের মাধ্যমে ভবন নির্মাণ শুরু হয়। ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে ‘অবৈধভাবে’ হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা হয় এবং এর বিনিময়ে টিউলিপ সিদ্দিকী ‘অবৈধ পারিতোষিক’ হিসেবে ইস্টার্ন হাউজিং থেকে ‘বিনামূল্যে’ একটি ফ্ল্যাট গ্রহণ করেন। এজাহারে অবৈধভাবে প্রভাবিত করে ইস্টার্ন হাউজিংকে আমমোক্তার অনুমোদনপূর্বক এবং ফ্ল্যাট বিক্রয়ের অনুমোদন করিয়ে অবৈধ সুবিধা দিয়ে ও নিজে অবৈধ সুবিধা নিয়ে বিনামূল্যে একটি ফ্ল্যাট গ্রহণ করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়েছে বলে দাবি করা হয়।

রাদওয়ান মুজিবের নামেও অবৈধ সম্পদের মামলা
প্রায় ৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ও সাড়ে ১২ কোটি টাকার সন্দেহভাজন লেনদেনের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গত ১৭ জুলাই মামলা করে দুদক।

ববি চাচা তারিক পরিবারের বিরুদ্ধে ৬২ কোটি টাকার দুর্নীতি
গত ১৭ জুলাই ৬২ কোটি টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জন, পাচার ও ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা ও রাদওয়ান মুজিবের চাচা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে পৃথক চার মামলা করে দুদক। মামলাগুলোতে তারিক সিদ্দিকের নামে ২৮ কোটি ৫৮ লাখ ৬৩ হাজার ২৩২ টাকার অবৈধ সম্পদ, তার স্ত্রী শাহিন সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ২৫ কোটি ৭৬ লাখ ৯৩ হাজার ২১৩ টাকা, তাদের দুই মেয়ে নুরিন তাসমিয়া সিদ্দিক ও বুশরা সিদ্দিকের বিরুদ্ধে যথাক্রমে ৩ কোটি ৩৭ লাখ ১৭ হাজার ১৯২ টাকা ও ৪ কোটি ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮৬ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়।

লাখ কোটি টাকার দুর্নীতির অনুসন্ধান
গত বছরের ডিসেম্বর থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচারের অভিযোগ এবং শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পরিবারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধানও চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে শেখ মুজিবের জন্মশত বার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ পালন এবং শেখ মুজিবের ১০ হাজারের বেশি ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণ করে অর্থ অপচয়, ক্ষতিসাধনের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহেনাসহ অন্যান্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন শেখ পরিবার, দুদকের মামলা

নিউজ ভুবন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৮ নভেম্বর ২০২৫ ১১:১১ এএম

দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন শেখ পরিবারের সদস্যবৃন্দ

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আওতায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবার ও তার বোন শেখ রেহানার পরিবারের বিরুদ্ধে ১৫টির বেশি মামলা দায়ের হয়েছে। চলছে অনিয়ম সংক্রান্ত মামলার তদন্ত কাজও।

এক বছরের ব্যবধানে শেখ পরিবারে বিরুদ্ধে প্লট, সেতুর টোল, সূচনা ফাউন্ডেশন, সিআরআইর অনুদান ও অবৈধ সম্পদের হাজার কোটি টাকার মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে।

শেখ হাসিনা ও তার পরিবার সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, দুদক নির্দিষ্ট কোনো বিষয় বা ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়ে কাজ করে না। দুদক আইন ও বিধি অনুসরণ করে তফসিলভুক্ত সব দুর্নীতির বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়। এক্ষেত্রেও দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা আইন ও বিধির মধ্যে থেকে তাদের তদন্তকাজ শেষ করবে। পরে আইনি পদক্ষেপ আদালত নেবে।

শেখ হাসিনাসহ পরিবার সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যত মামলা-

পূর্বাচলে ৬০ কাঠা প্লট নিয়ে আসামি শেখ পরিবার
রাজধানীর পূর্বাচলে ৬০ কাঠা প্লট বরাদ্দ নেওয়ার প্রমাণ পাওয়ায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে পুতুল ও তার বোন শেখ রেহানার পরিবারে সদস্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব সালাউদ্দিন এবং জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক ৮ অভিযোগপত্র বা চার্জশিট দাখিল করে দুদক। এর মধ্যে নিজ নামে পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর রাস্তার ৯ নম্বর প্লট নেওয়ার অভিযোগ শেখ হাসিনাসহ ১২ জনকে আসামি করে চার্জশিট দেওয়া হয় গত ১০ মার্চ। সব মামলা বর্তমানে বিচারাধীন পর্যায়ে রয়েছে। চলতি বছরেও রায় হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

গত ১২, ১৩ ও ১৪ জানুয়ারি তাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছিল। আসামিদের বিরুদ্ধে সরকারের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ও পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে বহাল থাকাকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের ওপর অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করে বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও অসৎ উদ্দেশ্যে পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর রাস্তার ৬টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ দুদক থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা গত ২৭ ডিসেম্বর জানিয়েছিল দুদক।

সেতুর টোলের ৩০৯ কোটি টাকা নয়-ছয়
মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায়ে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেডকে কাজ দিয়ে সরকারের প্রায় ৩০৯ কোটি ৪২ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি সাধনের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক মন্ত্রী কাদের ৭ মন্ত্রীসহ মোট ১৭ জনের বিরুদ্ধে গত ১২ অক্টোবর মামলা দায়ের করে দুদক। দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংস্থাটির সহকারী তানজিল বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

এ মামলায় আসামিরা হলেন— সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, সাবেক সচিব এম এ এন ছিদ্দিক, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফারুক জলিল, সাবেক উপসচিব মোহাম্মদ শফিকুল করিম, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. ফিরোজ ইকবাল, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান, সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আফতাব হোসেন খান, সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুস সালাম, সিএনএস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনীর উজ জামান চৌধুরী, পরিচালক সেলিনা চৌধুরী ও পরিচালক ইকরাম ইকবাল।

মামলা এজাহারে বলা হয়, ২০১৬ সালে মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায়ে দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেডে একক উৎসভিত্তিক দরপত্রে নিয়োগ দিতে পূর্বের টেন্ডার বাতিল করা হয়। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই শুধু সিএনএস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে ৫ বছরের জন্য সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করা হয় মোট আদায় করা টোলের ১৭.৭৫ শতাংশ। এর ফলে সিএনএস লিমিটেড মোট ৪৮৯ কোটি ৪৩ লাখ ৭৩ হাজার টাকা বিল গ্রহণ করে, যা একই মেয়াদের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক বেশি।

সেতুতে ২০১০-২০১৫ এই ৫ বছরে MBEL-ATT এই দুটি কোম্পানিকে জয়েন্ট ভেঞার কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে টোল আদায়ের ১৫ কোটি ৫৮ লাখ ৬৭ হাজার ৯১২ টাকায় নিয়োগ করা হয়। অথচ ২০২২-২০২৫ সালে মেঘনা-গোমতী সেতুতে ৩ বছরে ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে ভ্যাট ও আইটিসহ ৬৭ কোটি ৫৪ লাখ ৯১ হাজার ৪৬৬ টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয়। যা ৫ বছরে রূপান্তর করলে হয় ১১২ কোটি ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ১১০ টাকা। অতএব এমন নিয়োগের ফলে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৩০৯ কোটি ৪২ লাখ ৪৫ হাজার ৮৯০ টাকা।

জয়ের ৬০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ
৬০ কোটি ১৪ লাখ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও পাচারের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে গত ১৪ আগস্ট।

ওই মামলায় বলা হয়, স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে সজীব ওয়াজদ জয়ের মোট ৬১ কোটি ৪৬ লাখ ৮২ হাজার ৫১২ টাকার সম্পদের তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে তার ১ কোটি ৩২ লাখ ৮৬ হাজার ৪৮১ টাকার সম্পদের গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাকি ৬০ কোটি ১৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭০ টাকার সম্পদ জ্ঞাত আয় বহির্ভূতভাবে অর্জন করেছেন। এ অবৈধ সম্পদের মধ্যে তিনি অসাধু উপায়ে অর্থ পাচার করে আমেরিকাতে দুটি বাড়ি ৫৪ কোটি ৪ লাখ ৩২ হাজার ২৫৮ টাকায় ক্রয় করেন। জয় বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ায় আয়কর আইন মতে তার দেশ-বিদেশে অর্জিত ও অবস্থিত সম্পদের ঘোষণা আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক। তা সত্ত্বেও তিনি তার আয়কর নথিতে প্রদর্শন না করে দেশ থেকে বিদেশে অসাধু উপায়ে পাচার করে এবং নিজ নামের ২টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৫৭ কোটি ৫০ লাখ ৫৪ হাজার ৩১৫ টাকা সন্দেহজনক লেনদেন করেন।

সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে ৪৪৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ
সূচনা ফাউন্ডেশনের অনুকূলে অর্থ প্রদান ও কর ফাঁকির মাধ্যমে প্রায় ৪৪৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং প্রায় ৯৩১ কোটি টাকার মানিলন্ডারিংয়ের অপরাধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ১১ ট্রাস্টি, সালমান এফ রহমান ও আজিজ খানসহ ৮ ব্যবসায়ী এবং এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যানসহ ১৬ জন সদস্যদের বিরুদ্ধে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে মামলা করে দুদক।

দুদক বলছে, সূচনা ফাউন্ডেশন নামীয় নামসর্বস্ব ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে আসামিরা আয়কর আইনের ক্ষমতার অপব্যবহার কর মওকুফ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেন। যার মাধ্যমে তারা ৪৪৭ কোটি ৯৫ লাখ ৩০ হাজার ১৯৩ টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। এছাড়া ২০১৫–১৬ করবর্ষ থেকে ২০২৪–২৫ পর্যন্ত করবর্ষে মোট ৯৯ লাখ ৪ হাজার ৫৩১টাকা আয়কর প্রদান না করে প্রতারণা ও জাল জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন আর্থিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বা বিনিময়ে অবৈধ পারিতোষিক গ্রহণ করে সূচনা ফাউন্ডেশন নামীয় প্রতিষ্ঠানের ১৪টি ব্যাংক হিসাবে জমা ও উত্তোলনের মাধ্যমে মোট ৯৩০ কোটি ৯৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৫৯ টাকা লেনদেন করে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ করেছেন আসামিরা।

ওই মামলার আসামিরা হলেন, সূচনা ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ট্রাস্টি ও চেয়ারপার্সন প্রফেসর ডা. মাজহারুল মান্নান, ট্রাস্টি ও সাবেক ক্রীড়া মন্ত্রী মো. নাজমুল হাসান পাপন, ট্রাস্টি সায়ফুল্লাহ আব্দুল্লা সোলেনখী, সূচনা ফাউন্ডেশনের ট্রেজারার মো. শামসুজ্জামান, ট্রাস্টি জ্যান বারী রিজভী, ভাইস চেয়ারম্যান প্রফেসর প্রাণ গোপাল দত্ত, এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য প্রফেসর রুহুল হক, শিরিন জামান মুনির, এম এস মেহরাজ জাহান ও সদস্য ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

এছাড়া হামিদ রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যান ইন্তেকাবুল হামিদ, সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান ওরফে সালমান এফ রহমান, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আজিজ খান, সাবেক এমপি এ কে এম রহমাতুল্লাহ, ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান মঈন উদ্দীন হাসান রশিদ, মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ও বিল ট্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান এনায়েতুর রহমান।

অন্যদিকে এনবিআরের আসামিরা হলেন— সাবেক মুখ্যসচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, এনবিআর সাবেক সদস্য (কর অডিট, ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন) মীর মুস্তাক আলী, সাবেক সদস্য (ইন্টারন্যাশনাল ট্যাক্সসেস) চৌধুরী আমির হোসেন, সাবেক সদস্য (কর নীতি) পারভেজ ইকবাল, সাবেক সদস্য (শুল্ক নীতি) মো. ফরিদ উদ্দিন, সাবেক সদস্য (শুল্ক নিরীক্ষা) ফিরোজ শাহ আলম, সাবেক সদস্য (মূসক নীতি) ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন, সাবেক সদস্য (লিগ্যাল) ডা. মাহবুবুর রহমান, সাবেক সদস্য (কর তথ্য ব্যবস্থাপনা ও সেবা) লোকমান চৌধুরী, সাবেক সদস্য (মূসক) রেজাউল হাসান, সাবেক সদস্য (কর জরিপ ও পরিদর্শন) জিয়া উদ্দিন মাহমুদ, সাবেক সদস্য (কর প্রশাসন) আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক সদস্য (শুল্ক রপ্তানি ও বন্ড) এ এফ এম শাহরিয়ার মোল্লা ওরফে আবু ফয়সাল মো. শাহরিয়ার মোল্লা, সাবেক সদস্য (শুল্ক ও ভ্যাট শাখা) সুলতান মো. ইকবাল, সদস্য (বোর্ড প্রশাসন) তন্দ্রা সিকদার এবং সাবেক সদস্য (কর আপিল ও অব্যাহতি) কালিপদ হালদার।

সূচনা ফাউন্ডেশনের আরও ৩৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস ভুক্ত ব্যাংকের সিএসআর খাত থেকে সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে ৩৩ কোটি টাকা সহায়তার নামে আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে গত ২০ মার্চ মামলা করে দুদক।

ওই মামলায় সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে সিএসআর ফান্ড থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে ২০১৭ সালের মে মাসে ২০টি ব্যাংক থেকে ৩৩ কোটি ৫ লাখ টাকা সূচনা ফাউন্ডেশনের অনুকূলে প্রদানের জন্য বাধ্য করার অভিযোগ আনা হয়।

সিআরআইর অনুদানের ৪৩৯ কোটি টাকা লেনদেন
জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের অনুদানের নামে আত্মসাৎ, কর ফাঁকি ও ৪৩৯ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) চেয়ারম্যান জয়, তার মেয়ে পুতুল, শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান ও সাবেক অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামালসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয় গত ৬ নভেম্বর।

ওই মামলায় আসামিরা হলেন— সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা এবং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) চেয়ারম্যান সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয়, ট্রাস্টি ও ভাইস চেয়ারম্যান সায়মা হোসেন ওরফে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ রেহানার ছেলে ও ট্রাস্টি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল, ট্রাস্টি ও সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ (বিপু), এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর শাব্বির বিন শামস, সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া এবং সাবেক সদস্য (কর আপিল) রওশন আরা আক্তার।

মামলায় বলা হয়, জনকল্যাণের নামে প্রতিষ্ঠিত “সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) অনুকূলে ৪৫ কোটি ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ২৩টি কোম্পানির কাছ থেকে অবৈধভাবে অনুদান হিসেবে সংগ্রহ করে। যার মধ্যে ১৫ কোটি ৬৮ লাখ ৫৯ হাজার ৫২১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া সিআরআইয়ের নামে পরিচালিত ২৫টি ব্যাংক হিসাবে ২৪৭ কোটি ৮৫ লাখ ৩৬ হাজার ১৭০ টাকা জমা এবং ১৯১ কোটি ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৩০৯ টাকা উত্তোলনসহ মোট ৪৩৯ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে দুদক।

টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে প্লট দুর্নীতির মামলা
ঢাকার গুলশানের একটি প্লট ‘অবৈধভাবে হস্তান্তরের ব্যবস্থা’ করিয়ে দিয়ে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের কাছ থেকে ‘ঘুষ’ হিসেবে একটি ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও যুক্তরাজ্যের এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গত ১৫ এপ্রিল মামলা করে সংস্থাটি। মামলায় টিউলিপ সিদ্দিকসহ রাজউকের দুই কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়।

ওই মামলার এজাহারে বলা হয়, ১৯৬৩ সালে তৎকালীন বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী গুলশানে ১ বিঘা ১৯ কাঠা ১৩ ছটাক আয়তনের একটি প্লট বরাদ্দ পান। সরকারি ইজারা চুক্তি অনুযায়ী, ৯৯ বছরের মধ্যে ওই প্লট হস্তান্তর বা ভাগ করে বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল। তবে ১৯৭৩ সালে তিনি মজিবুর রহমান ভূঁইয়াকে আমমোক্তার মাধ্যমে প্লটটি হস্তান্তর করেন। এরপর প্লটটি ভাগ হয়ে বিক্রি হয় এবং ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলামের মাধ্যমে ভবন নির্মাণ শুরু হয়। ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে ‘অবৈধভাবে’ হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা হয় এবং এর বিনিময়ে টিউলিপ সিদ্দিকী ‘অবৈধ পারিতোষিক’ হিসেবে ইস্টার্ন হাউজিং থেকে ‘বিনামূল্যে’ একটি ফ্ল্যাট গ্রহণ করেন। এজাহারে অবৈধভাবে প্রভাবিত করে ইস্টার্ন হাউজিংকে আমমোক্তার অনুমোদনপূর্বক এবং ফ্ল্যাট বিক্রয়ের অনুমোদন করিয়ে অবৈধ সুবিধা দিয়ে ও নিজে অবৈধ সুবিধা নিয়ে বিনামূল্যে একটি ফ্ল্যাট গ্রহণ করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়েছে বলে দাবি করা হয়।

রাদওয়ান মুজিবের নামেও অবৈধ সম্পদের মামলা
প্রায় ৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ও সাড়ে ১২ কোটি টাকার সন্দেহভাজন লেনদেনের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গত ১৭ জুলাই মামলা করে দুদক।

ববি চাচা তারিক পরিবারের বিরুদ্ধে ৬২ কোটি টাকার দুর্নীতি
গত ১৭ জুলাই ৬২ কোটি টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জন, পাচার ও ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা ও রাদওয়ান মুজিবের চাচা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে পৃথক চার মামলা করে দুদক। মামলাগুলোতে তারিক সিদ্দিকের নামে ২৮ কোটি ৫৮ লাখ ৬৩ হাজার ২৩২ টাকার অবৈধ সম্পদ, তার স্ত্রী শাহিন সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ২৫ কোটি ৭৬ লাখ ৯৩ হাজার ২১৩ টাকা, তাদের দুই মেয়ে নুরিন তাসমিয়া সিদ্দিক ও বুশরা সিদ্দিকের বিরুদ্ধে যথাক্রমে ৩ কোটি ৩৭ লাখ ১৭ হাজার ১৯২ টাকা ও ৪ কোটি ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮৬ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়।

লাখ কোটি টাকার দুর্নীতির অনুসন্ধান
গত বছরের ডিসেম্বর থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচারের অভিযোগ এবং শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পরিবারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধানও চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে শেখ মুজিবের জন্মশত বার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ পালন এবং শেখ মুজিবের ১০ হাজারের বেশি ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণ করে অর্থ অপচয়, ক্ষতিসাধনের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহেনাসহ অন্যান্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক।

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর